সারাদেশে বাস ট্রাক বন্ধের ডাক

হটাৎ ডিজেলের বাড়ল দাম, ভোগান্তিতে জনগণ

Passenger Voice    |    ০৭:৪০ এএম, ২০২১-১১-০৫


হটাৎ ডিজেলের বাড়ল দাম, ভোগান্তিতে জনগণ

দ্রব্যমূল্য থেকে পরিবহন ব্যয়- জনজীবনের সর্বত্র জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ডিজেলের বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহারের দাবিতে আজ শুক্রবার ভোর থেকে সারাদেশে শুরু হয়েছে পণ্যবাহী যানবাহনের ধর্মঘট। আর ভাড়া বৃদ্ধির দাবিতে বাস বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মালিকরা। পরিবহন বন্ধ হওয়ায় সারাদেশে সৃষ্টি হতে যাচ্ছে অচলাবস্থা।

গত বুধবার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে প্রতি লিটার ৮০ টাকা করেছে সরকার। বাংলাদেশে ব্যবহূত জ্বালানির দুই-তৃতীয়াংশই ডিজেল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু পরিবহন নয়, কৃষি ও ব্যবসাতেও বিরূপ প্রভাব পড়বে। ঊর্ধ্বমুখী নিত্যপণ্যের দামে আরও গতি আনবে ডিজেলের নতুন দাম। কৃষি ও কলকারখানার উৎপাদন খরচ বাড়বে। রপ্তানিতেও বিরূপ প্রভাবের আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের। দাম বৃদ্ধির প্রত্যক্ষ প্রভাব গতকালই দেখা দিয়েছে পরিবহন খাতে। ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বাসের ভাড়া বেড়েছে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ৩৬ টাকার ভাড়া ৫০ টাকা নেওয়া হয়। জিগাতলা থেকে রামপুরা রুটের বাসে ১০ বাড়িয়ে ৪০ টাকা ভাড়া নেওয়া হয়। খবর দৈনিক সমকাল এর।

চালক কবির হোসেন জানালেন, তার বাস ডিজেলে চলে। এখন তার দৈনিক খরচ এক হাজার টাকা বেড়েছে। ভাড়া না বাড়িয়ে উপায় কী? যাত্রী আরিফুর রহমান বলেন, ১০ টাকা ভাড়া বাড়লে মাসে তার খরচ বাড়বে ৫০০ টাকা। এই টাকা তিনি কোথায় পাবেন?

ভাড়া বৃদ্ধির দাবিতে গতকাল বিকেল থেকেই রাজধানীতে বাস চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। অফিস শেষে ঘরমুখো মানুষ ভোগান্তিতে পড়েন। হেঁটে, বাড়তি ভাড়ায় রিকশায় কিংবা অটোরিকশায় তাদের বাসায় ফিরতে হয়েছে।

এদিকে, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ করেছে। পরিবহন ধর্মঘটে নৈতিক সমর্থন জানিয়েছে বিএনপি। দলগুলো বলেছে, গত সাত-আট বছর আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কম থাকলেও তখন দেশে জ্বালানির মূল্য হ্রাস করেনি সরকার। ৪০-৫০ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে। সেই লাভের টাকা কোথায়?

দাম বৃদ্ধির কড়া প্রতিক্রিয়া এসেছে পণ্যবাহী যানবাহনের মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো থেকে। এসব সংগঠনের শীর্ষ নেতারা সরকার সমর্থক কিংবা সরকারি দলের পদধারী হলেও সরাসরি ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও ধর্মঘটের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেছেন, 'মালিকরা গাড়ি বন্ধ রাখলে শ্রমিকরা কী করে চালাবে?'

তবে পণ্যবাহী সমিতির তুলনায় নমনীয় সরকার সমর্থক বাস মালিকদের সংগঠন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি গতকাল দুপুরেই বাস ভাড়া বৃদ্ধির আবেদন করে চিঠি দেয় সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছে। তবে বিভিন্ন জেলা-উপজেলার সমিতিগুলো সরাসরি বাস বন্ধের ডাক দিয়েছে।

বাংলামোটরের কার্যালয়ে বাস মালিকদের বৈঠক শেষে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ধর্মঘট ডাকা হয়নি। তেলের দাম এক লাফে ১৫ টাকা বাড়ায় দূরপাল্লার প্রতি ট্রিপে দেড় থেকে আড়াই হাজার টাকা খরচ বেড়েছে। এতে মালিকদের লোকসান হচ্ছে। লোকসান থেকে বাঁচতে কোনো মালিক যদি বাস চালাতে না চান, তাহলে বন্ধ রাখতে পারবেন।

তবে বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, বাস বন্ধ করতে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৈঠক থেকেই মালিকরা বাস বন্ধ রাখতে মোবাইল ফোনে নির্দেশ দেন নিজ নিজ পরিবহন কোম্পানিকে। সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান বলেছেন, লোকসান এড়াতে এ ছাড়া উপায় নেই।

রাজধানীতে বাস চলে গ্যাসে; তারপরও কেন বন্ধের সিদ্ধান্ত- এ প্রশ্নে মাহবুবুর রহমান বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ায় এখন ৮০ শতাংশ বাসই ডিজেলে চলে।

খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, সর্বশেষ ২০১৩ সালে দূরপাল্লার বাস ভাড়া বেড়েছিল। ডিজেলের দাম কমায় ২০১৬ সালে ভাড়া কিলোমিটারে ৩ পয়সা কমিয়ে ১ টাকা ৪২ পয়সা করে সরকার। গত আট বছরে যন্ত্রাংশ, বেতন-ভাতা, ভ্যাট-ট্যাক্সসহ সব দাম বেড়েছে। ২০১৯ সালে বিআরটিএর ব্যয় বিশ্নেষণ কমিটি দূরপাল্লার বাসে কিলোমিটারে ২ টাকা ৭ পয়সা এবং ঢাকা চট্টগ্রামের অভ্যন্তরীণ বাসের ভাড়া ১ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে কিলোমিটারে ২ টাকা ২১ পয়সা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছিল। সরকার সে ভাড়া কার্যকর করেনি। তেলের দাম ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় ভাড়া আরও বাড়ানো উচিত।

ভাড়া বৃদ্ধির আবেদন প্রসঙ্গে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, এ নিয়ে আলোচনা হবে। আগামী রোববার মালিকদের সঙ্গে বসবেন।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম বলেন, ব্যয় বিশ্নেষণ কমিটি সবকিছু পর্যালোচনা করে ভাড়া নির্ধারণ করবে। তা বিআরটি মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। সরকার অনুমোদন করলে ভাড়া বাড়বে। মালিকরা এ প্রক্রিয়া ছেড়ে বাস বন্ধ করলে জনগণের ভোগান্তি ছাড়া আর কিছু হবে না।

পণ্যবাহী পরিবহনের ধর্মঘট প্রসঙ্গে সচিব বলেন, তাদের ভাড়া সরকার নির্ধারণ করে না। মালিক ও পণ্য পরিবহনকারীর চুক্তিতে নির্ধারিত হয়। তাদের দাবির বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কিছু করার নেই।

ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, ট্যাঙ্কলরি মালিক শ্রমিক সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক রুস্তম আলী খান বলেন, মাত্র দু'দিন আগেই সেতুর টোল বেড়েছে। করোনায় সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে পরিবহন খাতের। এমন সময়ে তেলের দাম এক লাখে ১৫ টাকা বৃদ্ধি জুলুম। তাদের সংগঠনের সারাদেশের ২০০ শাখা ধর্মঘট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ডিজেলের দাম না কমা পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে।

পণ্যবাহী যানবাহনের মালিক-শ্রমিকদের সংগঠন ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব তাজুল ইসলাম বলেন, পরিবহনের বর্তমান নেতাদের সবাই সরকারের সমর্থক। তারা মনে করেন, শেখ হাসিনার সরকারের অর্থ সংকট নেই। সরকারকে বদনাম করতে তেলের দাম ও টোল বাড়ানো হয়েছে। এতে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তাই ধর্মঘট ডাকতে বাধ্য হয়েছেন। আশা করছেন, সরকার মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করে তেলের দাম কমাবে। তবে বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত আলোচনার ডাক পাননি।

পরিবহনের রাজনীতিতে সমন্বয় ও ঐক্য পরিষদের বিরোধী হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান ড্রাইভার ইউনিয়নের সভাপতি তালুকদার মনির বলেছেন, তারাও ধর্মঘটের পক্ষে। মালিক-শ্রমিকরা যৌথভাবে এ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।

কাভার্ডভ্যান মালিক আল আজগর বলেন, বঙ্গবন্ধু সেতুতে এক হাজার ৪০০ টাকার টোল পাঁচ হাজার টাকা হয়েছে। উত্তরবঙ্গে যেতে-আসতে সাত হাজার ২০০ টাকা খরচ বেড়েছে। বগুড়া-ঢাকা আসা-যাওয়ায় ডিজেল খরচ বেড়েছে সাত হাজার। এত ভাড়া দিয়ে কেউ পণ্য পরিবহন করতে চাইবে না। এতে ওভারলোডিং বাড়বে। রাস্তার ক্ষতি বাড়বে। দুর্ঘটনাও বাড়বে।

ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন বাস মালিক সমিতিও বাস বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে। কুমিল্লা ও রাজশাহীর সমিতিও একই কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।

তবে লঞ্চ মালিকদের সংগঠন জাতীয় নৌপরিবহন পরিষদের সভাপতি মাহবুবুর রহমান জানুয়েছেন, লঞ্চ চলছে। ডিজেলের মূল্যবৃদ্বির বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে আজ শুক্রবার তারা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেবেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবহন ছাড়াও ডিজেলে মূল্যবৃদ্ধির সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব কৃষিতে পড়বে। সেচনির্ভর ধান ও খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হবে। উৎপাদন ব্যয় ও দাম বাড়বে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন-বিএডিসির হিসাবে, দেশের ১৩ লাখ ৭৯ হাজার সেচ পাম্পের ৮৬ শতাংশ অর্থাৎ ১১ লাখ ৯২ হাজার ডিজেল চালিত। বোরো মৌসুমে দেশে ১৬ লাখ টন ডিজেলের ব্যবহার হয় সেচে। লিটারে ১৫ টাকা করে ডিজেলের দাম বাড়ায় তাদের মাথায় হাত পড়েছে।

ব্যবসায়ীরাও ক্ষতির কথা বলছেন। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, করোনার পর ব্যবসায়ীরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। এমন সময়ে তেলের দাম বৃদ্ধি ঠিক হয়নি। অন্তত আগামী জুন পর্যন্ত দাম না বাড়ালে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা করোনার ধকল থেকে ওঠার সুযোগ পেতেন। তেলের দাম বাড়ায় প্রত্যেক পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। পাইকারি থেকে খুচরা সব পর্যায়ে অস্থিরতা তৈরি হবে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বিবৃতিতে বলেছে, গত কয়েক বছর আন্তর্জাতিক বাজারে কম থাকলেও জ্বালানি তেলের দাম কমায়নি সরকার। বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার অজুহাতে ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পাগলা ঘোড়া বাজারে আগুন ছড়াবে।

ভোক্তা অধিকার সংস্থা কনশাস কনজ্যুমার্স সোসাইটির (সিসিএস) নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ বিবৃতিতে বলেন, করোনায় দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষ গরিব হয়েছে। দফায় দফায় নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি অমানবিক।